২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৪টি বিশেষ বিষয়ে প্রাধান্যের মধ্যে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি অন্যতম। একই সঙ্গে বাজেটে রাখা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও। টিআইবি, সিপিডিসহ বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে ‘সাংঘর্ষিক’ সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। এর মধ্য দিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এ বাজেটেই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট বক্তৃতায় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা আবশ্যক। অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য আমাদের অধিক পরিমাণ রাজস্ব জোগান দিতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে। ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু হওয়ার ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে-বলেন অর্থমন্ত্রী। এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। অর্থনীতির মূলস্রোতে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আয়কর আইনে কর প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করেছেন। সে অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন-ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
এ নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, কালো টাকা সাদা করার সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি সাংঘর্ষিক। কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাবটি অপরাধীকে সুরক্ষিত করার জন্য। যা নতুন অপরাধী বা অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নকে সক্রিয় রাখবে। এটি অর্থনীতির জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। অতীতেও এরকম সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি, বর্তমানেও আসবে না। ক্ষমতাসীন জোটের আরেক শরিক তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক তো বটেই। কালো টাকা সাদা করার প্রশ্নাতীত সুযোগ রাখা হয়েছে সরাসরি। আবার জমি ও ফ্ল্যাট কেনায়ও এ সুযোগ রাখা হয়েছে। আজকে যেসব দুর্নীতিবাজ ধরা হচ্ছে, তারা কালকে ছাড়া পেয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। সরকার পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে এটা করছে, দেখা যাক-টাকা আসে কি না!
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় এর আগে এনবিআরের বিশাল অংকের আয় হয়েছে। কালো টাকার আয় তো করের মধ্যে ছিল না। অনেকে মনে করছেন, এ সুযোগ দেয়া ঠিক হয়নি। এখন দেখার বিষয়, কী পরিমাণ আয় করে এনবিআর। তাতে বুঝা যাবে এটি ফলপ্রসূ হলো কি না। ক্ষমতাসীন জোটের শরিক গণআজাদী লীগের সভাপতি এস কে শিকদার বলেন, সবক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক বলা যাবে না। আবার ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিকও। যারা দুর্নীতি করে অর্থ কামাই করে, তাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে, বৈধ টাকা নিয়মের কারণে অবৈধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক নয়। আমাদের দেশে কালো টাকারও নানা ব্যাখ্যা আছে। কিছু সরাসরি অবৈধ, আবার কিছু নিয়মের ফাঁক গলে কালো হয়, কিন্তু মালিকের কাছে বৈধ। যেমন-জমি রেজিস্ট্রেশনে মৌজা রেট ধরার ফলে বিক্রেতার বিশাল অংকের টাকা অবৈধ হয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে তো সেটা অবৈধ নয়। এজন্য এটার নানা ব্যাখ্যা আছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন দিক থেকে পুঁজি যোগ হয়। চলমান ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সঙ্গে কিছু টাকা ছাড় দিয়ে যোগ করতে পারলে তো এখন ভালোই হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কালো টাকাকে সাদা করার এমন সুযোগের নিশ্চয়তা দেয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকে যেন সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সহজ করে বললে, সরকার দায়মুক্তির নিশ্চয়তা দিয়ে প্রকারান্তরে নাগরিককে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। রাজস্ব বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তিতে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার গভীরতা ও ব্যাপকতার বিকাশকে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হচ্ছে। দুর্নীতিকে লাইসেন্স দেয়ার এ প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ হবে, এটিই প্রত্যাশিত। মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিপরীতে সৎ করদাতাদের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর দেয়ার বিধান ‘বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে ড. জামান বলেন, বিষয়টি একজন সুনাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক, একই সঙ্গে তা সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর শামিল। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়ায় নৈতিক আপস করে প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায়ের স্বপ্ন স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদে কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। যার বড় উদহারণ হলো-দুই বছর আগে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। আবার দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলেও, কেউ সে সুযোগ নেননি। তাই বাজেটে এমন সুযোগ এলে কাদের স্বার্থে রাখা হচ্ছে-সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা মোটেই অমূলক নয়।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় না। এর মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ ধরনের পদক্ষেপ বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য করা হয়। কিন্তু এর ফলাফল আমরা দেখি না। একেবারে কালো টাকা সাদা করার জোয়ার এসেছে বা প্রচুর টাকা ফেরত এসেছে, এমন কিছুও দেখা যায় না।

লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিবিরোধী নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক
- আপলোড সময় : ০৭-০৬-২০২৪ ১০:১৫:০২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৬-২০২৪ ১২:০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন


নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ